ঢাকা , রবিবার, ০৯ মার্চ ২০২৫ , ২৫ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ই-পেপার

নির্বাচন নিয়ে বিএনপি-জামায়াত-এনসিপি ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব

আপলোড সময় : ০৭-০৩-২০২৫ ০৩:০৯:৫৩ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ০৭-০৩-২০২৫ ০৩:০৯:৫৩ অপরাহ্ন
নির্বাচন নিয়ে বিএনপি-জামায়াত-এনসিপি ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আন্দোলন ঘিরে আন্দোলনে থাকা সবগুলো দলের মধ্যে একধরনের ঐক্য স্পষ্ট হয়েছিল। কিন্তু ৫ আগস্টের পর সময় যতো গড়িয়েছে দলগুলোও তাদের নিজস্ব রাজনীতি আর কৌশল নিয়ে হাজির হয়েছে। বিএনপি শুরু থেকেই দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা বলে আসছে। জামায়াতে ইসলামী চাইছে, সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন। অন্যান্য দলগুলোও কমবেশি এর মধ্যেই ঘুরপাক খেয়েছে।

তবে ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বলছে, গণপরিষদ নির্বাচনের কথা। যেটাকে বিএনপি দেখছে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র হিসেবে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ঢাকায় সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে গণপরিষদের দাবির সমালোচনা করেন।
তিনি বলেন, ‘যারা গণপরিষদ নির্বাচনের বিষয়টি সামনে আনছে, হয় তারা বোঝে না অথবা বুঝেও আমাদের এই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আরও দীর্ঘায়িত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র আছে।’

এমন প্রশ্ন যখন উঠছে কোন কোন রাজনৈতিক দলের মধ্যে, তখন নির্বাচন কমিশন বলছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে গেলে জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে যাবে।

নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘আমরা যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করি তাহলে জাতীয় সরকার নির্বাচন অনেক পিছিয়ে যাবে। তখন প্রধান উপদেষ্টার তরফ থেকে ডিসেম্বর এবং পরের বছরের জুন নাগাদ যে একটা কথা বলা হয়েছে, সেটি রক্ষা করা সম্ভব হবে না।’

ফলে এমন বক্তব্যের মধ্যে প্রশ্ন উঠছে জাতীয় সংসদ, গণপরিষদ কিংবা স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে শেষপর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত আসে।

‘কারও চাহিদা পূরণের সময় এটা না’

বিএনপি ইতোমধ্যেই সেকেন্ড রিপাবলিক, নতুন সংবিধান কিংবা গণপরিষদের দাবির বিরোধিতা করেছে। দলটি মনে করছে, এর ফলে নির্বাচন পিছিয়ে যাবে।

দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যে কেউ যেকোনো কথা বলতেই পারে। কিন্তু সেটা পূরণের জন্য অবশ্যই জনগণের ম্যান্ডেট লাগবে।

আমীর খসরু বলেন, ‘এখানে ইলেকশন পেছানোর তো কোনো সুযোগ নাই। অলরেডি ডিসেম্বর ইজ টু লেইট। একেকদিন গণতন্ত্রহীন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এরকম একটা অবস্থা তো একদিনও থাকার প্রয়োজন নেই। আমাদের অনেকের অনেক চাহিদা থাকতে পারে। সে চাহিদা পূরণের সময় তো এটা না। সে চাহিদা পূরণ করতে হলে আপনাকে জনগণের কাছে যেতে হবে। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সংসদে আসতে হবে। সংসদের কাজই হচ্ছে, আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে সংবিধান সংশোধন। এটার জন্য নতুন কিছু আবিষ্কার করার প্রয়োজন নেই তো।’


নির্বাচন পেছানোর ইচ্ছা নেই, দাবি এনসিপির

হাসিনা সরকারের পতনের পর জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রথমে যে রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়, সেটা ছিলো সংস্কারকে ঘিরে। সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন আগে -এমন প্রশ্নের মধ্যে দ্রুত নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক চাপ তৈরি করে বিএনপি। সরকার অবশ্য ইতোমধ্যেই আগামী ডিসেম্বরকে ধরে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমার কথা জানিয়েছে। এরমধ্যেই জাতীয় নাগরিক পার্টির গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিকে ঘিরে রাজনীতিতে আবারও আলোচনা। কিন্তু গণপরিষদ নির্বাচন এবং এর মাধ্যমে নতুন সংবিধান তৈরির মতো সময়সাপেক্ষ দাবি তুলে ধরে ছাত্রদের দল এনসিপি কি আসলে নির্বাচন পেছাতে চায়? এমন প্রশ্নে এনসিপির জ্যেষ্ঠ্য যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল আসলাম আদিব অবশ্য তা নাকচ করে দেন।

‘গণপরিষদ নির্বাচন চেয়ে আমরা আসলে জাতীয় নির্বাচন পেছাতে চেয়েছি, এমন ধারণা সঠিক নয়। আমাদের দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ইতোমধ্যেই বলেছেন যে, গণপরিষদ নির্বাচন এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে হতে পারে। এটার জন্য কোন নির্বাচনই পেছাতে হবে না। সরকার প্রস্তুতি নিলে দুটি নির্বাচনই একসঙ্গে ডিসেম্বরে বা জুন মাসে সরকার যখন চাইবে সেটা সম্ভব।’-বলেন আদিব।

তিনি এ-ও বলেন, ‘এটা একসঙ্গে আমরা একারণে চাই, যেন নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংবিধান পরিবর্তন এবং নতুন সংবিধান করার ম্যান্ডেট পান, একইসঙ্গে তারা পাঁচবছর ক্ষমতায় থাকার ম্যান্ডেটও পান।’

নির্বাচন পেছানোর সন্দেহ কেন তৈরি হচ্ছে?

জাতীয় নাগরিক পার্টি বলছে, গণপরিষদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন পেছানোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু এরপরও যে নির্বাচন পেছানো নিয়ে সংশয়-সন্দেহ, তার কারণ রাজনীতিতে শুধু জাতীয় নির্বাচন নয় বরং স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়েও জোরালো আলোচনা দেখা যাচ্ছে। যেখানে জাতীয় নাগরিক পার্টি তো বটেই এমনকি জামায়াতের পক্ষ থেকেও জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে।

জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, তার দল মনে করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হওয়া দরকার। কারণ জানতে চাইলে জামায়াত নেতা পরওয়ার বলেন, ‘এখানে দুটো কারণ আছে। প্রথমটা হচ্ছে, এখন কোন সিটি করপোরেশনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নেই, পৌরসভায় নেই, উপজেলায় নেই। নিচের স্তরগুলোও নির্বাচনের অপেক্ষায় আছে। উন্নয়ন হচ্ছে না, মানুষ জনদুর্ভোগের প্রতিকারে তো জনপ্রতিনিধিকে পাচ্ছে না। ফলে স্থানীয় নির্বাচনটি দ্রুত দরকার।’

আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচনটা হয়ে যায়, তাহলে সেটা নিরপেক্ষ হবে বলেই আমরা আশা করি। তা না হলে যেকোনো রাজনৈতিক দলের অধীনেই নির্বাচন হোক না কোন, তারা সেটা কব্জা করে নিতে চাইবে। যে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য পনের/ষোল বছর আমরা অপেক্ষা করেছি, এখন দুই মাস আগে হলো না পারে সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, ইলেকশনটা সুষ্ঠু হচ্ছে কি-না। এই কারণেই আমরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনটা আগে চাই।’বলেন মিয়া গোলাম পরওয়ার।

তবে বিএনপি আবার এর বিপক্ষে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, স্থানীয় নির্বাচন করতে গেলেই জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে যাবে।

‘এই সরকারের ম্যান্ডেটের মধ্যে তো স্থানীয় সরকার নির্বাচন নাই। তারা করবে জাতীয় নির্বাচন। তারা যদি স্থানীয় নির্বাচনই করতে চায়, তাহলে শুধু স্থানীয় কেন, ট্রেড বডিগুলোর নির্বাচনও তারা করুক, মসজিদ কমিটির নির্বাচন করুক, আরও যতো কমিটি আছে সবগুলোর নির্বাচন করে তারপর জাতীয় নির্বাচন দিক!’

এছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই স্থানীয় নির্বাচন করে ফেলা ভালো- এমন ধারণাও নাকচ করছেন বিএনপি নেতা আমীর খসরু।

প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘যদি মনে করেন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ভালো নির্বাচন হবে। তাহলে প্রতিবার যখন স্থানীয় সরকার ইলেকশনের সময় হবে, তখন কি নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে আবার একটা ইন্টেরিম সরকার এনে তারপর নির্বাচন করবেন?

জাতীয় নাগরিক কমিটিও চায় স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হোক। তবে দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল আসলাম আদিব বলেন, যদি সারাদেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন সম্ভব নাও হয়, তাহলে প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সংখ্যক জেলা-উপজেলায় স্থানীয় সরকার নির্বাচন হতে পারে। এটা দরকার। কারণ প্রশাসনের প্রস্তুতি এবং সক্ষমতাও তখন আমরা যাচাই করতে পারব।’

স্থানীয় নির্বাচন আগে হলে জাতীয় নির্বাচন পেছাতে হবে বলছে নির্বাচন কমিশন

বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন সময়সাপেক্ষ। পাঁচ থেকে ছয় ধাপে এই নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সেক্ষেত্রে আগামী ডিসেম্বর বা জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করতে হলে এবং এর আগেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে তার তফসিল ঘোষণা করতে হবে এখনই।

যদিও নির্বাচন কমিশন বলছে, স্থানীয় নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কোন তথ্য তাদের কাছে আসেনি। নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘যদি আমরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যেতে চাই, তাহলে সরকারের প্রস্তুতিটাও লাগবে। একইসঙ্গে লাগবে রাজনৈতিক ঐকমত্য। সবকিছু মিলে যদি বিষয়টি একবিন্দুতে আসে, তখনই কমিশন স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দিকে যাবে।’ তার মতে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন ধাপে ধাপে করতে হয়। সেটা করতে গেলে অন্তত: একবছর সময় দরকার হবে।

আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করি তাহলে জাতীয় নির্বাচন অনেক পিছিয়ে যাবে। তখন প্রধান উপদেষ্টার তরফ থেকে ডিসেম্বর এবং পরের বছরের জুন নাগাদ যে একটা কথা বলা হয়েছে, সেটি রক্ষা করা সম্ভব হবে না।’

তবে জাতীয় নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যে হতে পারে প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্যকে সম্ভাব্য সময় হিসেবে ধরে নিয়ে নিজেদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে নির্বাচন কমিশন। আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘ভোটার তালিকা প্রণয়নের জন্য আমাদের একটা মিনিমাম সময় প্রয়োজন। সেটা আমরা জুনের মধ্যে করে ফেলব। এর মধ্যে আসন বিন্যাস হবে, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে, নির্বাচন সামগ্রীর কেনাকাটা হবে। একপর্যায়ে সব যখন হয়ে যাবে, তখন আমরা তফসিল ঘোষণার দিকে যাব। এখানে ডিসেম্বরটাই আমাদের টার্গেট।’ সূত্র: বিবিসি বাংলা।

নিউজটি আপডেট করেছেন : mainadmin

কমেন্ট বক্স

প্রতিবেদকের তথ্য

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ